বিশেষ প্রতিনিধি ঃ
বেলা ১২ টার সময় লিচু বাগানের মালিক তানভীর আলম বাড়ি ফেরার সময়ও গাছগুলো ছিল তরতাজা। দুপুর ৩ টায় আবার গিয়ে দেখেন বাগানের অধিকাংশ গাছের পাতা শুকিয়ে এসেছে। মাত্র ৩ ঘন্টার ব্যবধানে ধরন্ত লিচু গাছগুলো সব মারা গেছে। তার একটি বাগারের ৪২ টি গাছের মধ্যে ৩৩ টি গাছ মারা গেছে। আরো অন্য বাগান মিলিয়ে গাছ মরেছে ৬৬ টি।
তারভীর আলমের একার নয়, লিচু গ্রাম বলে পরিচিত ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের খয়েরতলা গ্রামের ৬ কৃষকের দেড় শতাধিক লিচু গাছ এভাবে মারা গেছে। সব বাগানের মালিকের দাবি গত ১৪ মে একযোগে এই ঘটনাটি ঘটেছে। কেন ঘটেছে বা কিভাবে ঘটেছে তার উত্তর গত ৪ দিনেও তারা পাননি। কৃষি বিভাগের লোকজনও সঠিক করে কিছু বলতে পারেনি বলে গ্রামবাসি জানান।
মঙ্গলবার সরেজমিনে খয়েরতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় মাঠে একাধিক লিচু বাগানে বড় বড় সব লিচু গাছ শুকিয়ে আছে। গাছে থরে থরে সাজানো লিচু, যেগুলো লাশ থেকে শুকনা পাতার রং ধারন করেছে। স্থানীয়রা অনেকে নষ্ট এই লিচু ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। বাগান মালিক তানভীর আলম জানান, তার বাবা মোদাচ্ছের হোসেন চাকুরী করেন। তিনিই এই ক্ষেত দেখাশুনা করছেন। তিনি জানান, ২৬ বছর পূর্বে তাদের এই গাছগুলো রোপন করা। তিনটি বাগানে তাদের প্রায় ১৫০ টি গাছ রয়েছে। ৬৮ শতাংশের এক বাগানে ৪২ টি গাছ রয়েছে। যে ক্ষেতে আর মাত্র ৯ টি গাছ বেঁচে আছে। একই ভাবে অন্য বাগানগুলোতেও একাধিক লিচু গাছ মারা গেছে। এখন পর্যন্ত তার ক্ষেতের ৬৬ টি গাছ মারা গেছে। তানভীর জানান, এবছর গাছগুলোতে প্রচুর পরিমানে লিচু এসেছিল। তারা আশা করছিলেন প্রতিটি গাছে ৭ থেকে ৮ হাজার লিচু পাবেন। যা বিক্রি করে প্রতিটি গাছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হবে। মোট গাছগুলো থেকে ২০ লাখ টাকার অধিক আয় হবে। সেই আশা নিয়ে বাগানের যতœ করে যাচ্ছিলেন। আর ১২ থেকে ১৫ দিন পর লিচু ভাঙ্গা শুরু করতে পারবেন আশা ছিল।
তানভীর আলম জানান, গত ১৪ মে বেলা ১২ টার সময়ও তিনি বাগানে ছিলেন। তখনও গাছগুলো তরতাজা। বাসা থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার বাগানে আসেন। এবার বাগান দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। দেখতে পান বাগানের বেশির ভাগ গাছের পাতা শুকিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, এআ গাছ মারা যাওয়ায় তার ১০ লাখের অধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখন গাছে শুকিয়ে যাওয়া লিচু এলাকার মানুষ ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।
আরেক কৃষক আবুল হোসেন জানান, প্রায় ২৫ থেকে ২৬ বছর পূর্বে তারাই প্রথম লিচুর আবাদ শুরু করেন। এখন গোটা খয়িরতলা গ্রামে অসংখ্য লিচু বাগান রয়েছে। যে কারনে অনেকে গ্রামটিতে লিচু গ্রাম বলেও চেনেন। তিনি আরো জানান, দীর্ঘদিন ধরে লিচুর চাষ করছেন কখনও এমন হয়নি। গত ১৪ মে তার ক্ষেতের ১১ টি গাছ এভাবে মারা গেছে। যে গাছগুলোতে হাজার হাজার লিচু ধরে আছে। আরেক কৃষক আব্দুল জব্বার জানান, তার ৩৫ টি গাছ ছিল। যার মধ্যে থেকে ২৫ টি গাছ এভাবে মারা গেছে। কি কারনে মারা গেল তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা কখনও একথা কখনও সেকথা বলছেন, প্রকৃত কারনে বলতে পারছেন না। বাকি যে গাছগুলো আছে সেগুলো রক্ষায় তাদের কোনো পরামর্শও নেই। তিনি বলেন, বাগান মালিকদের এই ক্ষতি দেখা যায় না।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী জানান, তারা ওই বাগানে কর্মকর্তা পাঠিয়ে কারন খুজে বের করার চেষ্টা করেছেন। বাগান মালিকরা যেভাবে বলছেন মাত্র ৩ ঘন্টার ব্যবধানে গাছগুলো মারা গেছে, এমনটা হবার কথা নয়। আস্তে আস্তে মাছগুলো মারা গেছে, চোখে পড়েছে ওই মুহুর্তে। তিনি বলেন, মাটিতে পানি জমে থাকলে, কেউ বিষ জাতীয় কিছু গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করলে বা মাটির উর্বর শক্তি নষ্ট হলে এমনটা হতে পারে। তারা মৃত্যুর কারন খুজে বের করার চেষ্টা করছেন বলে জানান।
কালীগঞ্জের সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (অবঃ) সিরাজুল ইসলাম জানান, পানি জমে থাকার কারনে এক সঙ্গে এতোগুলো গাছ মারা যাবার কথা নয়। তিনি মনে করেন আবহাওয়া জনিত কোনো কারনে হতে পারে। আবার অনেক সময় আবহাওয়া গরম থাকে, তার মধ্যে বৃষ্টি হয়। সেই ক্ষেত্রেও গাছের ক্ষতি হয় এমনকি গাছ মারা যেতে পারে। তবে এই গাছেল ক্ষেত্রে কি হয়েছে তা পরীক্ষা-নিরিক্ষা প্রয়োজন বলে দিনি মনে করেন। আর জলবায়ু নিয়ে স্থানীয় ভাবে কাজ করছেন সিডিপি’র এরিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুর রহমান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত চার বছর ধরে এ অঞ্চলে কখনও আম গাছ, কখনও নারিকেল গাছ এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ এই লিচু গাছগুলো শুকিয়ে মারা গেছে বলে তিনি মনে করেন।