বিশেষ প্রতিনিধি ঃ
রাতে অন্যের বাড়িতে ঘুমানোর আকুতি, দিনে মাঠের মাঝে চট পেতে খাবার খাওয়া। সেটাও আবার দিনে দুইবার। বাকি সময় প্রতিপক্ষের হামলার আশংকায় মাঠের মাঝে পাহারায় থাকা। এভাবেই দিন কাটছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বাকড়ি গ্রামের শতাধিক মানুষের, যারা নৌকায় ভোট দিয়ে বাড়িছাড়া হয়েছেন।
তাদের অভিযোগ প্রতিপক্ষ মটর সাইকেল প্রতিকের বিদ্রোহী প্রার্থী খন্দকার ফারুকুজ্জামান ওরফে ফরিদের সমর্থকরা নৌকার লোকজনের তাড়িয়ে গ্রামছাড়া করেছেন। ভোটের দিন রাত থেকেই তারা অদ্যবদি কখনও মাঠে আবার কখনও অন্য উপজেলার মধ্যে অবস্থান করছেন। তাদের গ্রামে ফেরা নিশেধ করে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি বৃহস্পতিবার সকালে গ্রামে থাকার অভিযোগে নিরিহ তিনজনকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।
এদিকে হরিশংকরপুর ইউনিয়নের নৌকা প্রতিক নিয়ে পরাজিত প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মাসুম জানান, ভোটের পর বাকড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন নেমে এসেছে। এছাড়াও গোটা ইউনিয়নের বেশ কয়েকজনের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুইজন অসহায় ভ্যান চালকের ভ্যান চালানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাঠের ফসলও ক্ষতি করা হয়েছে। লুট করা হচ্ছে গাছের ফল। তিনি এসবের প্রতিকার ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দাবি করেছেন।
প্রসঙ্গত, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন হরিশংকরপুর। গত ২৬ ডিসেম্বর এই ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। যাদের মধ্যে দুইজন ছিলেন শক্ত প্রতিদ্বন্দি, আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ছিলেন একজন। মূল প্রতিদ্বন্দি নৌকা প্রতিকের প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী খন্দকার ফারুকুজ্জামানের নিকট ৬০১ ভোটে পরাজিত হয়েছেন।
নৌকার কর্মীরা জানান, মটর সাইকেল প্রতিকের বিদ্রোহী প্রার্থী খন্দকার ফারুকুজ্জামান ওরফে ফরিদ এর নিজ গ্রাম নরহরিদ্রা। এটি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের আরেকটি গ্রাম বাকড়ি। এই বাকড়ি কেন্দ্রে মোট ভোটের সংখ্যা ২২ শত। যার মধ্যে মটর সাইকেল প্রতিকের প্রার্থী পেয়েছেন ১৩০১ ভোট, আর নৌকা পেয়েছেন ৪৮০ ভোট।
নৌকার কর্মীরা আরো জানান, নিজ ওয়ার্ডে প্রতিপক্ষ নৌকার প্রার্থী ৪৮০ ভোট পাওয়ায় মটর সাইকেলের কর্মীরা ক্ষুব্ধ হন। তারা ভোটের রাত থেকেই নৌকার কর্মীদের উপর হামলা শুরু করে। বাকড়ি গ্রামের বাসিন্দা ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি নূর আমিন মিয়া জানান, রাতে ভোটের ফল ঘোষনার পর তারা গ্রামে থাকতে পারেনি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোজা হয়েছে। যাদের রাস্তাতায় পেয়েছে তাদের তাড়া করে গাঁ ছাড়া করেছে। তিনি নিজেও ভোটের রাত থেকে পাশ্ববর্তী শৈলকুপা উপজেলার পিড়াগাড়ি গ্রামে পালিয়ে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে আরো মুক্তিযোদ্ধা নবের আলী, নবনির্চাচিত ইউপি মেম্বার বদরুল হাসান, যুবলীগের থানা সদস্য মিজানুর রহমান সহ অন্যরা মাঠের মধ্যে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
বাকড়ি গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, এই পিড়াগাতি গ্রামে প্রায় ৮০ জন একসঙ্গে রয়েছেন। তারা রাত হলেই অসহনিয় কষ্টে পড়েন। কে কোথায় ঘুমাবেন তা জানেন না। দিনের বেলায় মাঠে একজোট হয়ে প্রতিপক্ষের হামলার আশংকায় পাহারায় থাকেন। এখন তারা তিন বেলা খাবার খেতে পারেন না। সকলে মিলে একসঙ্গে বাজার করে ফাঁকা মাঠে রান্না করে খান। চাষের জমিতে কখন চট পেতে আবার কখনও মাটিতে বসে খেতে হচ্ছে। এভাবে দুই বার খাচ্ছেন। তিনি বলেন, শীতের রাতে মানুষের বাড়িতে ঘুমানোর কথা বলা কষ্টকর। তারপরও অসহায় অবস্থা দেখে তাদের থাকতে দিচ্ছেন। কিন্তু এভাবে কতদিন পারবেন তা বলতে পারছেন না। ইতিমধ্যে অনেকে বলতে শুরু করেছে আপনারা কিছু একটা করেন। আনন্দ বিশ্বাস জানান, তার ছেলের শশুর বাড়িতে থাকছেন। তারা আপাতত থাকতে দিয়েছেন, তবে এভাবে আর কত দিন।
নরহরিদ্রা গ্রামের সিয়াম হোসেন জানান, নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে পাইকপাড়া গ্রামের রাজিব হোসেন ও আব্দুল হামিদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরানপুর গ্রামের বাকি বিশ্বাস, সামছুদ্দিন আর আল আমিনের পেয়াজের ক্ষেত নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বাকড়ি গ্রামের শওকত আলী প্রায় ৬০ শতক জমিতে থাকা চায়না কমলা গাছ থেকে ছিড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এভাবে গোটা ইউনিয়নে নৌকার সমর্থকদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বাড়িতে থাকা নারীদের নানা ভাবে গালাগাল করা হচ্ছে। তিনি অসহায় মানুষগুলোর নিরাপত্তা চেয়েছেন। তিনি বলেন, গ্রামে থাকার অপরাধে বৃহস্পতিবারও হোসেন নেওয়াজ, নয়ন ও মেহেদী নামের তিনজনকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খন্দকার ফারুকুজ্জামান এর মুটোফোনে কথা বলার চেষ্টা করলে একটি নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। অপর ফোনটি বাঁজলেও তিনি ধরেননি। আর স্থানীয় হরিশংকরপুর পুলিশ ফাঁড়ির আইসি ফারুক হোসেন জানান. ভোটের পর একটু উত্তেজনা থাকে তবে এখন পরিস্থিতি ভালো। গ্রামছাড়াদের বিষয়ে জানান, ভোটের রাতে তারা গ্রাম ছেড়েছে। যারা গ্রাম ছেড়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এসেছে, অন্যরাও ফিরবে বলে তিনি আশা করছেন।