আবদুল হাকিম রাজ,মৌলভীবাজার থেকেঃ
৩৪ বছর আগে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত মৌলভীবাজার জেলাধীন রাজনগর উপজেলার কাশিমপুর পাম্প হাউসটি প্রকল্পভুক্ত এলাকার কৃষি ও কৃষকের জন্য বর্তমানে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ২২ হাজার হেক্টর জমির অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করে আউশ, আমন ও বোরো ফসল রক্ষা করা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ হলেও এখন তা কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।প্রকৃতপক্ষে, প্রকল্পটির সুবিধা ভোগ করছেন সরকার দলীয় বিল ইজারাদাররা এবং এ কাজে আইনের ফাঁক-ফোকরকে কাজে লাগিয়ে তাদের সহযোগিতা করছেন পানি উন্নয়ন বোডের্র (পাউবো) কিছু অসাধু কর্মকর্তারা। এ কারণে ৮টি পাম্পের মধ্যে সচল থাকে ৪টি ও বন্ধ থাকে ৩টি এবং একটি পাম্পের যন্ত্রপাতি খোলা। এদিকে, পাম্প হাউসের ভেতরে কাদাপানি জমে থাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনারও ঝুঁকি রয়েছে।ভৌগলিকভাবে কাশিমপুর পাম্প হাউসের অবস্থান মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায়। এ পাম্প হাউস এলাকার সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৪৪ হাজার ১শ’ ১৪ জন এবং এ এলাকার ২৪.০৭৬ হেক্টরের মধ্যে কৃষিযোগ্য জমি ১৮.০৪৮ হেক্টর, সেচযোগ্য জমি ১২.১৪০ হেক্টর, নিষ্কাশনের জন্য জমি ১০.৪৪০ হেক্টর।এছাড়া এ এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ৫৯ কিলোমিটার, সেচখাল ১০৮.৭০ কিলোমিটার, ১০টি স্লুইসগেট, ৯টি সাইফুন, ৩৩০ কিলোওয়াটের ৮টি পাম্প এবং অন্যান্য সেচ ট্রাকচার ২৬৪টি।জানা গেছে, প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৭৮ সালে পশ্চিম জার্মানির কেএসবি কোম্পানি কাশিমপুরে পাম্প হাউসটি নির্মাণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মেকানিক কার্যক্রমের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যেই প্রকল্পে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরুতে পাম্প হাউসের দায়িত্বে ছিলেন ৩ জন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, ৬ জন সহকারী প্রকৌশলী, অপারেটর, পিয়ন, নাইটগার্ডসহ প্রায় ২৫ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন ১২ সদস্যের আনসার বাহিনী। আরও জানা গেছে, পাম্প হাউস বাবদ সরকার প্রতি বছর বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকা। পাম্পের বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় হয় ১ কোটি টাকারও বেশি।মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, প্রকল্প তৈরির সময় কাওয়াদিঘি হাওরের উত্তর প্রান্তের ভাটেরা পাহাড় থেকে আসা প্রায় ১৪টি ছড়ার পানি পরিকল্পনায় না আনায় গত ৩৪ বছরেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। এলাকাবাসী জানায়, এ কারণে ছড়ার পানি এবং বর্ষা মৌসুমে হাওরে জমে থাকা বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে পাম্প হাউসটি অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে পারে না। ফলে, এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এর ফলে, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়। আবার বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে আমন ধান রোপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে মেশিন রিপিয়ারিং (ওভার ওয়েলিং) করা হয়। এ রিপিয়ারিং কাজটি জার্মানিভিত্তিক সিমেন্স কোম্পানি পেলেও কুমিল্লা থেকে মেকানিক এনে কাজ করানো হয়। এতে করে ১টি ৬ ব্র্যান্ড রেগুলেটর, ১টি ৩ ব্র্যান্ড রেগুলেটর, ১টি ফিসপাস রেগুলেটর পানি নিষ্কাশন এবং পানি ধরে রাখার কোনো কাজে আসছে না। ৬ ব্যান্ড রেগুলেটরের ৩টি গেট ভেঙে যাওয়ায় কুশিয়ারা নদীর পানি হাওরে ঢুকে ফসলহানি ঘটায়।১৯৯৫ সালের ৭ জানুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান পাম্প হাউসের পাশের ফিসপাসটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে জাপানি কারিগরি সহায়তায় ফিসপাসটি তৈরি এবং ১৯৯৬ সালে এটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়।ফিসপাসটি স্থাপনকালে এশিয়া মহাদেশের প্রথম বলে দাবি করা হয়। এটি চালুর পর মাছের ওঠানামা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় এবং দেখা যায়, প্রতিকূল পরিবেশের কারণে মাছের ওঠানামা প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে। এর অন্যতম একটি কারণ, কুশিয়ারা নদীর বাম তীরে সুউচ্চ ও দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ নির্মাণ করার ফলে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে বাঁধের সরাসরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে, নদী থেকে মাছ হাওরে উঠতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া চৈত্র মাস ডিমওয়ালা মাছের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় ফিসপাসের সামনের গভীর জলাশয় (অভয়ারণ্য) থেকে প্রতিবছর মাছ হাওরে উঠে আসে। কিন্তু, প্রতিবছর ইজারাদাররা অভয়ারণ্যে বিষটোপ ফেলে সব মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে করে এলাকার গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাশিমপুর পাম্পের নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসভবনের ভেতরে বর্তমানে গরু-ছাগলের মলমূত্র, খড়, ধান রাখেন একজন সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান। এখানে একটি আনসার ব্যারাক অপারেটর কলোনি রয়েছে। ৮ জন অপারেটরের বদলে ৫ জন কমর্রত থাকার কথা হলেও এখানে বর্তমানে ৩ জন নিয়মিত অবস্থান করেন। অভিযোগ রয়েছে, পাম্প হাউসের অধিকাংশ কর্মকর্তাই জেলা সদরে বসবাস করেন।মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোডের্র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে পাম্পগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, পাম্পগুলো পুরনো। তাই, নষ্ট হওয়ায় মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোডের্র ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ের মেকানিকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অচিরেই এগুলো মেরামত কাজ সম্পন্ন করে আবার লাগানো হবে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডে ৮২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির মধ্যে মাত্র ২৮ জন কমর্রত রয়েছেন। সে কারণে অনেক কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারছে না এবং সঠিক তদারকির অভাবে পাম্পহাউসের যন্ত্রপাতিগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ দিয়েছেন। এলাকাবাসীর স্বার্থে এখানে দ্রুত লোক নিয়োগ প্রয়োজন বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও নির্বাহী কর্মকর্তা মনে করেন।