তারিফুজ্জামান ঃশতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মামলার মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে একটি। এই মামলাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবীরা আদালতে মুখোমুখি হবেন আগামী ১১ ও ১২ই জানুয়ারি। আর গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে তাদের দিকে।
ইসরায়েল কি গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা করছে? দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু তাই মনে করে এবং সেই অভিযোগ তুলেই তারা গত ২৯ ডিসেম্বর দ্বারস্থ হয়েছে ‘দ্য হেগ’-এর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস (আইসিজে)-এর।ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামেন নেতানিয়াহু অবশ্য জানিয়েছেন, তার দেশ গাজা প্রচারাভিযানে যে ‘নৈতিকতার’ পরিচয় দিয়েছে, তা ‘নজিরবিহীন’। সেখানকার এক সরকারি মুখপাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগকে ‘ব্লাড লিবেল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।প্রসঙ্গত, ব্লাড লিবেল এমন একটি শব্দ যা মধ্যযুগে ইউরোপে উদ্ভূত ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রক্তপাতের মিথ্যা অভিযোগ বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হতো।
দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা ৮৪ পৃষ্ঠার ওই নথিতে বলে হয়েছে ইসরায়েলের কার্যকলাপ কিন্তু ‘চরিত্রগত ভাবে গণহত্যাই’ কারণ তারা গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের একটি বড় অংশকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল।যুক্তিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ‘গণহত্যামূলক’ কার্যকলাপের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, গুরুতর মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি করা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে ‘সমগ্রভাবে ওই গোষ্ঠীর শারীরিক ক্ষতি হয়’। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বক্তব্যে কিন্তু তাদের গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে ওই নথিতে।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ার আইন বিভাগের অধ্যাপিক জুলিয়েট ম্যাকিনটায়ার জানিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার পেশ করা খসড়া ‘সচেতন ভাবে তৈরি’ ও তাতে সমস্ত বিষয় ‘সবিস্তারে’ উল্লখ করা হয়েছে।তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এটি (খসড়া) ইসরায়েলের সমস্ত সম্ভাব্য যুক্তির উত্তর দিতে পারে… এবং আদালতের এক্তিয়ারের বাইরের দাবির জবাবও দিতে সেটি প্রস্তুত।’
দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়েছে, এই মামলাটি দায়ের করার আগে, বিভিন্ন জায়গায় তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের কথা জানিয়েছে।ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র আইলন লেভি বলেছেন, তারা (ইসরায়েল) মামলাটি লড়বে। তিনি আরও বলেন, হামাস যে যুদ্ধ শুরু করেছে , তারাই এর সম্পূর্ণ নৈতিক দায় বহন করেছে।ইউএন জেনোসাইড কনভেনশন (১৯৪৮) অনুযায়ী, ‘গণহত্যা’ হল একটি জাতীয়, জাতিগত, বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে করা একটি কাজ। এর মধ্যে রয়েছে, কোনও একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা, ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যাতে শারীরিক ক্ষতি হয়, জন্ম প্রতিরোধ করতে ব্যবস্থা নেওয়া, গোষ্ঠীর বাচ্চাদের জোর করে অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর করা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর মধ্যে গণহত্যা প্রমাণ করা সবচেয়ে কঠিন।
একটি রাষ্ট্র বা ব্যক্তি গণহত্যায় অভিযুক্ত হতে পারে। ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইকেল বেকার জানিয়েছেন, একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন করা আর কোনও ব্যক্তিকে গণহত্যার জন্য দায়ী করার মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য বেশ জটিল এবং বিভ্রান্তি তৈরি করে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ইউরোপে নাৎসিরা ৬০ লক্ষ ইহুদিদের হত্যা করেন। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশন স্বাক্ষর করেন বিশ্বনেতারা।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিয়ানমার, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হল অনুমোদনকারী ১৫৩টি দেশের মধ্যে কয়েকটি।
ইন্টারন্যাশানাল ক্রিমিনাল কোর্টের কী কাজ
ইন্টারন্যাশানাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০২ সালে এবং এটিও দ্য হেগে অবস্থিত। ডোমেস্টিক কোর্ট ব্যর্থ হলে আইসিসি-ই শেষ অবলম্বন। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইসরায়েল কিন্তু আইসিসি-র সদস্য নয়।
ফৌজদারি মামলার শুনানি হয় এই আন্তর্জাতিক আদালতে। যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার জন্য কোনও ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে আইসিসি। আইনে প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। মামলা চালু করেন আইসিসির প্রসিকিউটর।
বিবিসি’র সৌজন্যে