বিশেষ প্রতিনিধি
বার্ড ফ্লু রোগের ভ্যাকসিন তৈরী হচ্ছে ঝিনাইদহে। এই জেলার এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস নামের একটি প্রতিষ্ঠান দেশে প্রথমবারের মতো এই ভ্যাকসিন তৈরীর কাজ শুরু করেছেন। যা আগামী জুন মাস থেকে বাজারে নিয়ে আসতে পারবেন বলে প্রতিষ্ঠানটি আশা করছেন। ইতিমধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ‘ইধহমষধ নরৎফ ভষঁ ঐ৯ ঠধপ’ (বাংলা বার্ড ফ্লু এইচ৯ ভ্যাক) নামের ভ্যাকসিনটি উৎপাদন ও বিপনন অনুমোদন দিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন।
এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ময়মনসিংহের মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ আলিমুল ইসলামের তত্বাবধানে ড. কোহিনুর পারভীন, ড. মোস্তফা কামাল ও ড. আয়নুল হক প্রতিষ্ঠানটির গবেষণাগারে দীর্ঘ গবেষণা করে এই ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন। এছাড়া তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১৫ জন উৎপাদন কর্মকর্তা তাদের সহযোগিতা করেছেন। এরপরই তারা সফলতা পেয়েছেন। কর্মকর্তারা আরো জানান, বার্ড ফ্লু রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে পোলট্রি শিল্পকে রক্ষায় ইতিপূর্বে চীনসহ কয়েকটি দেশ থেকে এই ভ্যাকসিন আমদানি করতে হয়েছে। এতে অনেক বিড়াম্বনার স্বীকার হতে হয়েছে। এখন দেশেই পাওয়া যাবে এই ভ্যাকসিন, খরচও কম হবে বলে আশা তাদের।
উৎপাদক প্রতিষ্টান এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মখলেছুল ইসলাম জানান, ২০০০ সালে ঝিনাইদহের রাউতাইল এলাকায় তাদের এই কারখানা প্রতিষ্টা করা হয়। জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নির্জন এলাকায় ৪ একর জমির উপর তারা এই কারখানাটি প্রতিষ্টা করেন। ২০০১ সাল থেকে তারা উৎপাদনে যান। তারা মূলত প্রাণীর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পে বার্ড ফ্লু একটি মারাত্বক সমস্যা। বার্ড ফ্লু এর কারনে হাজার হাজার পোলট্রি খামারি সর্বশান্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে চীন, ভারত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ভ্যাকসিন ব্যবহার করে খামারিরা এই রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু সময়মতো ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে প্রায় তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। পাশাপাশি ভ্যাকসিনের মুল্যও বেশি গুনতে হতো খামারিদের। তখনই এগিয়ে আসেন এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড। তাদের প্রতিষ্টানের মাধ্যমে ২০১৪ সালে প্রফেসর ড. মোঃ আলিমুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল গবেষক বার্ড ফ্লু রোগের টিকা আবিষ্কারে গবেষণা শুরু করেন। দীর্ঘ প্রচেষ্ঠার পর ২০১৭ সালে স্থানীয় ভাবে পৃথকীকৃত ভাইরাস দিয়ে পোলট্রি শিল্পের জন্য মারাত্বক এই রোগ প্রতিরোধ কার্যকর বার্ড ফ্লু ভ্যাকসিন তৈরীতে সক্ষম হন। এরপর মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগসহ নানা পক্রিয়া সম্পন্ন করে বাজারজাত শুরু করেছেন। তিনি জানান, দুইদফা খামারে প্রয়োগ করা সহ নানা পক্রিয়া শেষ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। প্রথম দফায় এফএনএফ তাদের নিজস্ব খামারে ও পরে ঔষধ প্রশাসনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অন্য একটি খামারে প্রয়োগের মাধ্যমে এই ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হয়।
এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মখলেছুল ইসলাম আরো জানান, অনুজীব বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এই ভ্যাকসিন উৎপাদনে কতটুকু সক্ষমতা তাদের রয়েছে যা দেখতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল ঝিনাইদহে আসেন। তারা কারখানা পরিদর্শণ করেন এবং বার্ড ফ্লু রোগের ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থাকায় উৎপাদন এবং বাজারজাত করার অনুমতি দেন। গত ৫ মে তারা এই অনুমোদন পেয়েছেন, এরপর থেকে তারা উৎপাদন শুরু করেছেন। গত সপ্তাহে তারা বাজারজাত শুরু করেছেন। প্রায় এক কোটি ভ্যাকসিন বাজারে ছাড়ার কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। মখলেছুল ইসলাম জানান, বার্ড ফ্লু রোগে একটি মুরগীকে তিনটি ডোজ ভ্যাকসিন দিতে হয়। প্রথম ডোজ বাচ্চার বয়স ৭ থেকে ১৪ দিন এর মধ্যে, দ্বিতীয় ডোজ ২৮ দিনে আর শেষ ডোজ ৬ মাস বয়স হলে দিতে হয়। প্রতি ডোজের মুল্য পড়ে ৬ থেকে ৮ টাকা। কিন্তু তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের মুল্য পড়বে প্রতি ডোজ সাড়ে ৫ টাকা। এতে খরচ কম হবে খামারিদের। তিনি আরো জানান, প্রতি বছর তাদের কারখানার ১৫ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, তাদের কারখানায় শুধুমাত্র বার্ড ফ্লু ভ্যাকসিন তৈরীর জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমব্বলিত একটি ভবন রয়েছে। তিনি মনে করেন তাদের এই ভ্যাকসিন উৎপাদন দেশের পোলট্রি শিল্পের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। তারা ইতিপূর্বে গরুর খুরা রোগের ভ্যাকসিন, গামবোরো ভ্যাকসিন, ফাউল কলেরা ভ্যাকসিন, রাণীক্ষেত ভ্যাকসিন সহ নানা ভ্যাকসিন উৎপাদন করে থাকেন। ২০০৭ সালে তারাই প্রথম খুরা রোগের ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করেন।
এ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রমের প্রধান প্রফেসর ড. মোঃ আলিমুল ইসলাম জানান, এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস প্রাণীর স্বাস্থ্য বিষয়ে যা যা করছেন তা প্রশংসনীয়। তারা গবেষনা করে বার্ড ফ্লু ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন তা একটা যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এর মাধ্যমে আমাদের পোলট্রি শিল্পের মালিকরা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন। তিনি আরো বলেন, দেশে এই প্রথম বার্ড ফ্লু ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে, যেটা ঝিনাইদহের এই এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস করছে। এটা আমাদের সকলের জন্য গর্বের বিষয়। তিনি আরো বলেন পোল্ট্রি শিল্প ছাড়াও প্রাণী সম্পদ রক্ষায় প্রতিবছর আমাদের দেশে যে পরিমান নানা প্রকারের ভ্যাকসিন প্রয়োজন হয় তার ৫ ভাগ দেশে উৎপাদন হয়। এর মধ্যে এফএনএফ ফামাসিটিক্যালস করে ৪ ভাগ, আর সরকারি ভাবে হয় ১ ভাগ। বাকি ৯৫ ভাগ আমাদের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে বছরে সাগে ৪ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এফএনএফ এর এই বার্ড ফ্লু ভ্যাকসিন বাজারে আসার পর অনেকটা অর্থ সাশ্রয় হবে।
ঝিনাইদহ জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার আনন্দ কুমার অধিকারী জানান, এফএনএফ ফার্মাসিটিক্যালস বার্ড ফ্লু ভ্যাকসিন তৈরী ও বাজারজাত করার অনুমোদন পেয়েছেন এটা অবশ্যই ঝিনাইদহের জন্য গর্বের। তারা পূর্বে গরুর খুরা রোগ ও মুরগির রাণীক্ষেত সহ আরো বেশ কয়েকটি প্রাণী স্বাস্থের ভ্যাকসিন উৎপাদন করে। তিনি নিজে ওই কারখানা পরিদর্শন করেছেন এবং তাদের কার্যক্রম ভালো লেগেছে বলে জানান।