দেশে এ বছর প্রথম সাত মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা আগের বছরগুলোর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত বছর সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন। দেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানোর পর থেকে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ। কিন্তু এ বছরের শুধু জুলাই মাসে সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ১৫ হাজার ৬৫০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। ফলে প্রথম আট মাসের প্রধমার্ধ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৮০৪ জন। গত রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তির এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। এর মধ্যে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৮৭০ জন। এটাও এ বছর আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর এক দিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এর আগে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল গত ১ অগাস্ট, সেদিন ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৭১২ জন।
তারপর দুদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও রোববার আবার বেড়ে গেছে। এই এক হাজার ৮৭০ জনের মধ্যে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে এক হাজার ৫৩ জন এবং দেশের আট বিভাগে ৮১৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
সরকারি হিসাবে জানানো হয়েছে, রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক ছাড়িয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রোববার সকালে মারা গেছেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহাবুদ্দীন কোরেশীর স্ত্রী সৈয়দা আক্তার (৫৪) ও কুষ্টিয়ায় চৌধুরী নুরুল নাহার হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রাশেদুজ্জামান রিন্টুসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন বলে জানা গেছে। সারা দেশে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে সাত হাজার ৩৯৮ ডেঙ্গু রোগী। আর চিকিৎসা শেষে ১৭ হাজার ৩৮৮ জন ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগে নতুন ডেঙ্গু রোগী ১৫৯ ও চিকিৎসাধীন ৪১৬ জন, খুলনা বিভাগে নতুন ১২৭ ও চিকিৎসাধীন ৪২১ জন, রাজশাহী বিভাগে নতুন রোগী ৮৩ জন ও চিকিৎসাধীন ৩৪২, বরিশাল বিভাগে নতুন ৭৮ জন ও চিকিৎসাধীন ২২৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে নতুন ৭০ জন ও চিকিৎসাধীন ২৬৮ জন, রংপুর বিভাগে নতুন ৫৩ জন ও ভর্তি ২১৫ জন এবং সিলেট বিভাগে নতুন শনাক্ত ৩১ জন ও হাসপাতালে ভর্তি ৯৯ জন।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, এবার ডেঙ্গু কেড়ে নিল কুষ্টিয়ার চৌধুরী নুরুল নাহার হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রাশেদুজ্জামান রিন্টুর প্রাণ। তিনি শনিবার বিকালে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে মারা যান বলে নিশ্চিত করেছেন ভেড়ামারা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ডা. একেএম কাওছার হোসেন। এদিকে কুষ্টিয়ায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে স্কুলছাত্রসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে রোববার সকালে মো. মঞ্জুর শেখ (১৫) নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী খুলনার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অন্যদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান মর্জিনা বেগম (৬৫) নামে আরেকজন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন খুলনার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ দুটি মৃত্যুই খুলনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা।
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। গতকাল রোববার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছে আরো ৪ জন। বর্তমানে শিশুসহ ৪৩ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুছ জানিয়েছেন।
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, শরীয়তপুরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সংখ্যা অর্ধশতাধিক বলে জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার একজন ঢাকায় চিকিৎসারত অবস্থায় মারা গেছেন। এখনো আক্রান্ত রয়েছে ৪৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে আরো ১৫ জন।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাট জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরো ৮ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে ৫ জন বাগেরহাট সদর হাসপাতাল ও বাকিরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার। ফলে রোববার দুপুর পর্যন্ত জেলায় সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ জনে।
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, বরগুনায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে তাওহীদ নামে দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সোহরাব উদ্দিন।
সিভিল সার্জন ডা. হুমায়ুন শাহিন খান জানিয়েছেন, বরগুনায় ৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরের মতলবে ডেঙ্গু জ্বরে লাভলী বাশার (৩২) নামে এক নারী ইউপি সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। গত শনিবার রাত ৩টায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি উপজেলার ৩নং খাদেরগাঁও ইউপির সংরক্ষিত ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য, তার বাড়ি নাগদা এলাকায়।
চাঁদপুর ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আনোয়ারুল আজিম জানান, চাঁদপুর সদর হাসপাতালে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪৮ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ২০ জন।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। রোববার নতুন করে গাইবান্ধা সদর আধুনিক হাসপাতালে আরো ৫ জন ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে এ পর্যন্ত গাইবান্ধায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২৩ জনে।
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গোপালগঞ্জে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। রোববার দুপুর পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৩২ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ জনে। এর মধ্যে ১৯ জন গোপালগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। আর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ১৭ জন। বাকি ২ জন বাড়িতে চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. তরুণ মণ্ডল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
যশোর প্রতিনিধি জানান, যশোরে প্রতিদিনিই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। গতকাল যশোর জেনারেল হাসপাতালে আরো ১২ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৫৮ জন।
যশোর সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ দিনে যশোর জেলায় মোট ১৪৮ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, পাবনার চাটমোহরে গত ৭ দিনে এক নারীসহ ৬ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগটি নির্ণয়ের ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন ‘সন্দেহভাজন’ রোগী ও তার স্বজনরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ছুটতে হচ্ছে জেলা সদরের হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকে। এতে অর্থ ও সময় দুটোই অপচয় হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত মোট কতজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, মাগুরা সদর উপজেলার জয়া সাহা নামে এক গৃহবধূ ডেঙ্গু আক্রান্ত অবস্থায় ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে রোববার ভোরে মারা গেছেন। দুই সন্তানের জননী জয়া সাহা পুটিয়া গ্রামের চঞ্চল মিত্র’র স্ত্রী।
মাগুরার সিভিল সার্জন প্রদীপ কুমার সাহা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরো জানান, মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩২ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।