বিশেষ প্রতিনিধি
নিত্য হালদার ৬২ বছর বয়সের মধ্যে ৪০ বছরই কোটচাঁদপুরের জয়দিয়া বাওড়ে মাছ ধরার কাজ করেন। এই মাছ ধরেই চলে তার সংসার। এক মেয়ে চম্পা হালদারকে বিয়ে দিয়েছেন, আর এক ছেলে অনিক হালদার বর্তমানে যশোর এম.এম কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মার্স্টাস পড়ছে। গোকুল হালদার কালীগঞ্জের মর্জাদ বাওড়ে মাছ ধরেন ৩৫ বছর। তার একার আয়ে চলে ১০ জনের সংসার। মহেশপুরের কাঠগড়া বাওড়ে ৫০ বছর মাছ ধরছেন সাধন কুমার হালদার। তার পরিবারেও ৮ সদস্য। যারা সবাই সাধন কুমারের উপর নির্ভরশীল।
নিত্য, গোকুল ও সাধনের মতো ঝিনাইদহ ও যশোরের ৬ টি বাওড় পাড়ে বসবাসকারি প্রায় ১ হাজার পরিবার কর্ম হারিয়ে পথে বসতে চলেছে। এতোদিন তারা ওই ৬ বাওড়ে মাছ ধরে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। সম্প্রতি সরকারের ভুমি মন্ত্রনালয় এগুলো ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ইতিমধ্যে দরপত্র আহবান করা হয়েছে। মৎস্যজীবীরা বলছেন, বর্তমানে বাওড়গুলো ‘বিল ও বাওড় মৎস্য উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এতে তাদের ৪০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। বাওড়ের মাছ ধরার কাজ তারাই করেন। আর ইজারা দিলে আপতদৃষ্টিতে সরকার এককালীন বেশি আয় দেখালেও বাওড়গুলো নানামুখি ক্ষতির মুখে পড়বে। ধংশ হবে জীববৈচিত্র্য। বাওড়গুলো চলে যাবে প্রভাবশালীর দখলে। মালিকানা হারিয়ে মৎস্যজীবীরা পথে বসবে। মাছ চাষে সার-ঔষধের ব্যবহারে বাওড় থেকে রাণী মাছও হারিয়ে যাবে। বাওড়গুলো ঘিরে সরকারের যে লোকবল রয়েছে, তারাও হবে বেকার। যে কারনে তারা চলমান নিমিমালায় বাওড়গুলো পরিচালনার দাবি তাদের।
মৎস্য অধিদপ্তরে খোজ নিয়ে জানাগেছে, ঝিনাইদহের মহেশপুরে কাঠগড়া ও ফতেপুর, কোটচাঁদপুরে বলুহর ও জয়দিয়া, কালীগঞ্জে মর্জাদ এবং যশোরের চৌগাছায় বেড়গোবিন্দপুর বাওড়টি বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে বাওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প এর আওতায় মাছ চাষ শুরু করে। ১৯৭৯ সাল থেকে ৩০ বছর মেয়াদী বিল ও বাওড় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। এই সময়ে মাছ চাষের উপযোগি করতে বাওড়গুলোতে পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামো, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, অফিস, আবাসিক ভবন, গার্ডসেটসহ নানা অবকাঠামো নির্মান করা হয়। পরবর্তীতে দুই দফায় আরো ২৪ বছর প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে অদ্যবদী এটি বাওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প রাজস্ব খাতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। একজন প্রকল্প পরিচালক এগুলো দেখভাল করেন, কর্মকর্তা কর্মচারি আছেন ১১০ জন। এছাড়া এই ৬ টি বাওড়ে রেনু সরবরাহের জন্য কোটচাঁদপুরে একটি কেন্দ্রীয় হ্যাচারী রয়েছে। যেখানে ২৯ টি পুকুর আছে।
অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, ৬ টি বাওড়ে নিদৃষ্ট অংকের মাছ ছাড়া হয়। প্রতি বছর মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। বাওড়ের কর্মরতরা এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন করে থাকেন। এই মাছ চাষের মাধ্যমে বাওড় পাড়ের হালদারদের জীবন-মান উন্নত করতে বাওড়ে যে মাছ থাকবে তার ৬০ শতাংশ সরকার, আর ৪০ শতাংশ হালদাররা পেয়ে থাকেন। এছাড়া বাওড়ের পানিতে যে ছোট ছোট দেশিয় মাছ থাকে তা সবই হালদারদের প্রাপ্য। তারা এই মাছও বিক্রি করে অর্থ উপার্যন করেন। এভাবে একদিকে সরকার মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা পুরণ করছে, অন্যদিকে বাওড় পাড়ের হালদারদের জীবন-মান উন্নয়ন করে যাচ্ছিলেন। চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল ভুমি মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের চুক্তি শেষ হচ্ছে। এই চুক্তি শেষ হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পরিবর্তে বাওড়গুলো ইজারা দেওয়ার পক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ২২ সালের ডিসেম্বর বাওড়গুলো ইজারা দরপত্র আহবান করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এগুলো ইজারা পক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ফতেপুর বাওড় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি সুশান্ত কুমার হালদার জানান, বাওড়গুলো ঘিরে তারা জীবন-যাপন করে থাকেন। ফতেপুর ও কাঠগড়া বাওড়ে ১৫০ জন মৎস্যজীবী রয়েছেন। বলুহর ও জয়দিয়া বাওড়ে কাজ করেন আরো ৪৭২ জন। মর্জাদ বাওড়ে আছেন ১৪৫ জন ও বেড়গোবিন্দপুর বাওড়ে ২১০ জন মৎস্যজীবী নিয়মিত কাজ করেন। বাওড় সরকারের হাত থেকে চলে গেলে এরা সবাই বেকার হয়ে পড়বে। আর এদের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন আরো কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষ, যারা পথে বসবে।
জয়দিয়া বাওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি নিত্য হালদার জানান, তারা বাওড়ে কোনো প্রকার সার-ঔষধ ছাড়াই মাছ চাষ করে থাকেন। পাশাপাশি টেংরা, পুটি, শিং, কৈ, পাবদা, খলিসা, বাটা সহ নানান প্রজাতির দেশিয় মাছ বাওড়ে লালন করে বিক্রি করেন। বাওড়ের পানিতে থাকা জীববৈচিত্র্য অক্ষুন্ন রেখে তারা মাছের চাষ করেন। কিন্তু ইজারা দিলে কৃত্রিম চাষ শুরু হবে, হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য ও দেশিয় মাছ।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মোঃ আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, মৎস্য বিভাগ চেষ্টা করছেন বর্তমান প্রকল্পের মেয়ার বৃদ্ধি করে চলমান নিয়মে মাছের চাষ করা। কিন্তু ভুমি মন্ত্রনালয় এগুলো ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা হলে অনেকে পথে বসবেন। মৎস্য বিভাগের অনেকে বেকার হয়ে যাবেন।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, বাওড়পাড়ের মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে ভুমি মন্ত্রনালয় মৎস্য অধিদপ্তরের এক প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষের জন্য দিয়েছিল। কিন্তু তারা সফলতা আনতে পারেনি। যে কারনে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা স্থানীয় ভাবে দাপ্তারিক কাজ করছেন মাত্র। তিনি আরো বলেন, বাওড়পাড়ের হলদারদের বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে তিনি কথা বলবেন বলে জানান।