এম.পলাশ শরীফ,বাগেরহাট:
সুন্দরবনে জেলে, বাওয়ালী ও বনদস্যুদের জন্য এক সময় মুর্তিমান আতংক ও সুন্দরবনে ঘুরতে আসা পর্যাটকদের মধ্যে অন্যতম আকর্ষন ছিল হরিন, কুমির ও বনের রক্ষা কবজ হিসাবে খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জেলে, বাওয়ালী, বনদস্যু ও চোরা শিকারীদের হামলায় এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন বন্যপ্রানীসহ দুই প্রজাতির কুমির। এক সময় বাংলাদেশে তিন ধরনের কুমির ছিল। এর মধ্যে মিষ্টি পানির কুমির ও ইন্ডিয়ান ঘড়িয়াল এখন সম্পূর্ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর সর্বশেষ ১৯৮৭ সালে রাজশাহীর পদ্মনদীতে দেখা গিয়েছিল মিষ্টি পানির কুমির। আইআরএম এর ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপ মতে সুন্দরবনের নদী ও খালে ১শ ৬০ থেকে ১শ ৮০টি লোনা পানির কুমির রয়েছে বলে ওই জরিপে বলা হয়। কিন্তু বর্তমানে সুন্দরবনের অবশিষ্ট রয়েছে একমাত্র লোনা পানির কুমির। আর সেটিও এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আর এ সল্প সংখ্যক লোনা পানির কুমিরের বিলুপ্তির ঠেকাতে বন বিভাগের উদ্যোগে কৃত্রিম প্রজাননের মাধ্যমে কুমিরের বংশবৃদ্ধি করার জন্য ২০০২ সালে সুন্দরবনের করমজল এলাকায় কুমিরসহ সুন্দরবনের বন্যপ্রানী রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত হয় করমজল কুমির প্রজননকেন্দ্র। আর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ২০১৫ সাল পর্যন্ত এখান থেকে ৮১টি কুমির প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে অবমুক্ত করা হয়। আর সমপ্রতি সুন্দরবন করমজল প্রজনন কেন্দ্রের লোনা পানির নারী কুমির (জুলিয়েট) দেয় ৫১ টি ডিম যার মধ্যে ৩৬ টি ছানা ও পিলপিল কুমিরের ডিম থেকে ৩৭টি বাচ্চার জন্ম হওয়ায় সুন্দরবনের নদী-খাল ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় নিয়োজিত অতন্ত্র প্রহরী হিসাবে খ্যাত লোনা পানির এ কুমির নিয়ে পুনরায় ঘুরে দাড়াতে চায় সুন্দরবন। সুন্দরবনে করমজল কুমির প্রজানন কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয় জেলেদের জালে ধরা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি কুমির দিয়ে। বর্তমানে এ কেন্দ্রে মিঠা পানির দুটি নারী কুমির, লোনা পানির দুটি নারী কুমির (জুলিয়েট ও পিলপিল) এবং একটি পুরুষ কুমির রোমিও রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যনত্ম জুলিয়েট ও পিলপিল থেকে কেন্দ্রে গত ১০ বছরে ৬২৫টি ডিম থেকে ৩৯২টি বাচ্চা ফুটেছে। আর বর্তমানে সুন্দরবনের এ কুমির প্রজনন কেন্দ্রে বনের নদীসহ বিভিন্ন খালে অবমুক্তির জন্য লালন-পালন করা হচ্ছে ২শতাধিক লোনা পানির কুমির। বনবিভাগ সূত্রে আরো জানাগেছে, বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির লোনা পানির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও তা সংরক্ষণে ২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে বন বিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র সরকারি এ কুমির প্রজননকেন্দ্র। বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন প্রকল্পের আওতায় ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে আট একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় এ কেন্দ্রটি। এছাড়াও সারা দেশে বেসরকারী ভাবে ময়মনসিং ও রামুতে বেসরকারী ভাবে দুটি কুমির প্রজনন কেন্দ রয়েছে। যে গুলো থেকে ইতি মধ্যে কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো সম্ভব হয়েছে। দেশের কুমির বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির কুমিরের অসিত্মত্ব ছিল। লবণ পানির কুমির, মিঠা পানির কুমির ও গঙ্গোত্রীয় কুমির বা ঘড়িয়াল। এর মধ্যে মিঠা পানির কুমির ও ঘড়িয়ালের বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন শুধু লবণ পানির কুমিরের অসিত্মত্বই আছে। এরা সাধারণত ৭০-৭৫ বছর পর্যনত্ম ডিম দিতে পারে। আর ১০০-১২০ বছর পর্যনত্ম বেঁচে থাকে। ডিম থেকে ছানা ফুটার পর ৫ বছর বয়সে বা ২ মিটারের কাছাকাছি হলে সেই কুমির গুলিকে প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য অবমুক্ত করা যেতে পারে।করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের সহ-ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ তৌহিদুর রহমান জানান, গত ১ জুন প্রজনন কেন্দ্রের পুকুর পাড়ে কুমির ‘পিলপিল’ ৬১টি ডিম পাড়ে। পুকুর পাড় থেকে ডিমগুলো সংগ্রহ করে টানা ৮৫ দিন কেন্দ্রের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার পর ওই ডিম থেকে গত ২৪ আগষ্ট ৩৭টি বাচ্চা ফুটে বের হয়। ভ্রক্ষনের মৃত্যু ও অনিষিক্ত হওয়ার কারনে এবার ২৪টি ডিম নষ্ট হয়ে যায়। এর আগে গত ১৯ মে এই প্রজনন কেন্দ্রের অপর কুমির ‘জুলিয়েট’ ৫১টি ডিম পাড়ে। ওই ডিমের মধ্য থেকে একই নিয়মে গত ৫ আগষ্ট ৩৬টি বাচ্চা ফুটে বের হয়। ভ্রক্ষনের মৃত্যু ও অনিষিক্ত হওয়ার কারনে জুলিয়েটের ১৫টি ডিম নষ্ট হয়ে যায়। জুলিয়েটের ৩৬টি কুমির ছানাও সম্পুর্ন সুস্থ্য রয়েছে বলে তিনি জানান। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ সাইদুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রে কুমির লালন-পালন ও অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি যে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রসত্মাব পাঠানো হয়। চলতি অর্থবছরেও এ খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রসত্মাব পাঠানো হয়েছে।##