‘চারিদিকে ন্যুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/তাদের সত্মনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল,/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/ পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’-প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এভাবেই ধরা পড়েছে সোনালি ধানের প্রাচুর্য। বাংলা মাস অগ্রহায়ণের আর্ভিবাবের সাথে সাথে চির সবুজের চিরায়ত আবহমান বাংলার চারদিক থাকে কুয়াশায় আচ্ছন আর কৃষকের গোলায় উঠতে শুরম্ন করে পাকা সোনালী আমন ধান। এটি কালের চিরায়ত বাংলার অগ্রহায়ণের চিরচেনা রূপ। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কৃষকের মাঠে এখন সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। সারা দেশের ন্যায় এখানেও শুরু হয়েছে আমন ধান কাটার মৌসুম।
কৃষক রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরে। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হবে আনন্দঘন পরিবেশে। তৈরি হবে নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর-পায়েস।
কৃষক-কৃষাণিরা আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নবানেণ বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইউর’ আনা হয়। নতুন ধান ঘরে ওঠার পাশাপাশি পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে মিলাদ পড়ানোর প্রথা প্রচলিত রয়েছে এই উপজেলায় সাথে রেওয়াজও আছে মসজিদে সিন্নি দেওয়ার। হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকের ঘরে ঘরে পালন করা হয়ে থাকে পূজার আয়োজন।
মিরসরাই উপজেলার বাতাসে এখন আমন ধানের সু-ঘ্রাণ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আগাম জাতের সোনালী রঙের আমন ধান ক্ষেতে দোল খাচ্ছে ধানের শিষ। ক্ষেতে ক্ষেতে ধরেছে কাঁচা সোনার রং।
উপজেলায় ইতিমধ্যে আমন ধান প্রাথমিকভাবে কাটা শুরু হয়েছে অগ্রহায়ণের শুরু থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা পোকামাকড় আক্রমণ ও দমন পরামর্শ, পার্চিং পদ্ধতি, সারিবদ্ধভাবে রোপণ, জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার, এলসিসি ব্যবহার, গুটি ইউরিয়া ব্যবহার, সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার, নতুন জাত চাষাবাদে উদ্ধুদ্ধ করার ফলে আমনের ভালো ফলন হয়েছে বলে দাবী করছেন কৃষকরা।
উপজেলায় বরাবরের মতো আমনের ভালো ফলন হয়েছে ১ নম্বর করেরহাট ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নে। আবাদ হওয়া আমনের জাতের মধ্যে অন্যতম ব্রী ধান ৪৯ এবং ব্রী ধান ৪৪ এর ফলন অন্য জাতের তুলনায় খুবই ভালো হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশী আবাদ হয়েছে ব্রী ধান ২২ জাত। এছাড়া ও উপজেলার ১৬ টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভায় আবাদকৃত ধানের জাতসমূহ হচ্ছে ব্রী ধান ৫১, ব্রী ধান ৫২, ব্রী ধান ৪০, ব্রী ধান ৪১, ব্রী ধান ৩৯, ব্রী ধান ৩২, ব্রী ধান ৩৩, ব্রী ধান ৩০, ব্রী ধান ২৩, ব্রী ধান ১০, ব্রী ধান ১১।
উপজেলার একাধিক কৃষকের সাথে কথা বললে তারা জানান, ইতিমধ্যে কিছু কিছু জমির পাকা আমন কাটা শুরম্ন হয়েছে। আগামী সপ্তাহ পরই তাদের ঘরে পুরোপুরিভাবে উঠতে শুরম্ন হবে সোনালি আমন ধান। অনুকূল আবহাওয়া, সার ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহায়তা পাওয়ায় এবার ধানে রোগবালাই তেমন একটা হয়নি। ইতোমধ্যে মাঠের প্রায় সব ধান পেকেও গেছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আইয়ুব আলী জানান, চলতি বছর উপজেলায় আমন ধান চাষ হয়েছে ১৯ হাজার ৫ শত হেক্টর জমিতে। এর লÿ্যমাত্রা ধারন করা হয়েছিল ১৯ হাজার ২৫০ হেক্টর। যা গত বছরের তুলনায় কম। তবে লÿ্যমাত্রার তুলনায় বেশী। গত বছর লÿ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৭৯০ হেক্টর এতে চাল উৎপাদন হয় ৫০ হাজার ১৮৬ মেট্টিক টন। গত বছরে তুলনায় চলতি বছর আমনের কম চাষাবাদের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ধানের বাজার মূল্য কম, উৎপাদন খরচ বেশী।
সরেজমিনের পরিদর্শনে গেলে কথা হয় উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের কৃষক জহুরুল হক, কাটাছরা ইউনিয়নের আবুল কাশেম, ইছাখালী ইউনিয়নের রফিউজ্জামান, মঘাদিয়া ইউনিয়নের নিজাম উদ্দিনের সাথে। তারা বলেন, আমনের ফলন খুব ভালো হয়েছে। এ বছর ছিলনা পোকামাকড়ের আক্রমণ। তবে ধানের বাজার মূল্য কম দাবী করে তারা বলেন ধানের আবাদের সময় ট্রাক্টর দিয়ে চাষ দেয়া, শ্রমিকের মজুরি সব কিছু মিলিয়ে খরচের পালস্না ভারী হয়ে যায়। তবে সরকার কৃষকের এসব বিষয় বিবেচনা করে ধানের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে দিলে এতে করে তারা লাভবান হবে বলে মনে করছেন।
উপজেলার ১২ নম্বর খৈয়াছরা ইউনিয়নের কৃষক শহীদ বলেন, তিনি তার আবাদকৃত জমিতে হাইব্রীড ধানী জাতের আমন চাষ করছেন গত তিন বছর যাবত। প্রতি বছরের ন্যায় চলতি বছরও ফলন ভালো হয়েছে। ভালো ফলন হওয়ায় তিনি খুশী হলেও একটাই তার চিমত্মা খরচের তুলনায় ধানের বাজার মূল্য কম। তিনি আশা করছেন আর মাত্র এক সপ্তাহ পরই এই ধান কাটা যাবে।