ইয়ানুর রহমান, শার্শা (যশোর)ঃ ০২ ডিসেম্বর। দিগন্তের হাল্কা কুয়াশার রেখা দেখা দিয়েছে । খেজুর গাছের মাথার আস্তরণ তুলে তাতে মাটির ভাড় টানাতে শুরু করেছে গাছিরা। এমন দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় শীত আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আসছে খেজুর রসও। শীতের সকালে কাঁপা কাঁপা হাতে খেজুর রস পানের মধুর দৃশ্যও মনে দোলা দেয়। প্রকৃতির নিয়ম মেনে এবারও শীত আসছে। গাছিরা মাটির ভাড় নিয়ে ছুটছে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য।
শীতের সকালে রসের পায়েস ছিল নিত্যদিনের খাবার, সে কথা মনে পড়লে আজও জিহ্বায় পানি আসে। এখন শীতের পদধূলি। আসছে খেজুর রসও। তবে এবার সে রসের পরিমান খুব বেশি থাকবেনা বলে মনে করছেন গাছীরা। তারা বলছেন, শুধু এ বছর নয়, গত কয়েক বছর ধরেই যশোরের শার্শায় খেজুর গাছগুলোতে কমছে রসের পরিমাণ।
সরেজমিনে কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০০ সালের সেপ্টম্বরে ভারত থেকে উজানে পানি এসে শার্শাসহ যশোরের ৩টি উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা সংঘঠিত হয়ে জলাবদ্ধতা শুরু হলে খেজুর গাছ মরতে শুরু করে। এখন থেকে মাত্র ২০ বছর পিছন ফিরে তাকালে দেখা যেত শীতকালে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে পিঠার উৎসব হতো। পিঠা উৎসবের প্রধান উপকরণ চাউলের গুড়া ও দ্বিতীয়ত গুড়। বন্যার করালগ্রাসের কারণে এ অঞ্চলে গুড়ের উৎপাদন কমার সাথে সাথে পিঠা উৎসব-এর ধুম নেই বললেই চলে। খেজুরের রস ও গুড় বিক্রয় করে সংসার চালাতে উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লীতে এমন গাছির সংখ্যা কম ছিল না। বর্তমানে সারা গ্রাম খুঁজলেও একজনও গাছি মেলা ভার।
বাংলার ঐতিহ্যের সূচী থেকে এভাবে লোভনীয় বস্তুটি এত দ্রুত হারিয়ে যাবে কেউই তা মানতে নারাজ। শার্শা উপজেলায় এক সময় এ ঐতিহ্যবাহী খেজুর রসের জন্য বিখ্যাত হলেও এখন তা আর নেই। কার্তিক শেষ হয়ে অগ্রাহায়ন হতে চললো কিন্তু কোথাও কোনো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের অয়োজন চোখে পড়ে না। রাস্তার পাশে কিংবা বাড়ির আঙ্গিনায় কেউ খেজুর গাছ রোপন করছে না। এটি এখন দুর্লভ বস্তু হিসেবে পরিণত হয়েছে। উপজেলার কাশিয়াডাঙ্গা, সম্মন্ধকাঠি, জিরেনগাছা, কাঠুরিয়া, উলাশী, খাজুরা, শ্যামলাগাছী, সুবর্নখালী সহসব প্রায় প্রতিটি গ্রামে তথ্যচিত্র প্রায় একই রকম।
এ সম্পর্কে কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের এলাকার এক সময়কার নামকরা গাছি আব্দুল মাজেদ (৭০) বলেন, ‘এখন শীতের সময় খেজুর রস নেই এটা বিশ্বাস করতে পারি না। খেজুর গাছ কাটার পিছনে জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়েছি।
বুরুজ বাগান গ্রামের মোজাম্মেল হক জানান, ‘ শহর থেকে আত্মীয় স্বজনেরা শিতের সময় আসেন। তারা কখনও গুড় কিংবা প্রথম পাটালি (নুলেনী) না নিয়ে যান না। তাদের দৃষ্টিতে শার্শার গুড় মানেই সেরা। শুধু শহর নয়, অনেকে এখান থেকে গুড় ও পাটালি কিনে দেশের বাইরেও পাঠান।’
শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, খেজুর গাছ থেকে রস পেতে হলে সবার আগে খেজুর গাছ সংরক্ষণ করতে হবে। এখন গ্রামের কেউ আর খেজুর গাছ রোপন করতে চায় না। এজন্যই ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস কিংবা খেজুর গুড় পেতে হলে প্রতি বছর বৃক্ষরোপনের সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খেজুর গাছ রোপনের উপর জোর দিতে হবে। নতুবা চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের বাঙালীর ঐতিহ্য খেজুরের রস।