আজ বৃহস্পতিবার ১২ এপ্রিল পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিখ্যাত চড়ক মেলা শুরু হয়েছে। ১৬ এপ্রিল সোমবার পর্যন্ত এ মেলা চলবে। মেলা ও পূজা উপলক্ষে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন মরা বড়াল নদীর তীরে বোঁথড় গ্রামটি হয়ে ওঠে তীর্থক্ষেত্র। খুব প্রাচীন আমল থেকে বোঁথড়ের চড়ক পূজা চলছে। শুদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তির বার্তা নিয়ে মহাদেবের আর্বিভাব হয়। সে সময় উচ্চ হিন্দু সম্প্রাদায় দ্বারা নিম্নবর্ণ হিন্দু নিগৃহীত হতো। এ পূজা প্রচলন হয় বান রাজার আমলে। শত শত বছর ধরে চলছে এই পূজা। ২২ চৈত্র সন্ধায় পাঠ ঠাকুরের পাঠে ধুব দিয়েই শুরু হয় পূজানুষ্ঠান। বোঁথড় শিব মন্দির থেকে পাঠ নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ি বাড়ি। এই পর্বকে বলা হয় মাল বা গ্রস্থ। ২৬ ও ২৭ চৈত্র মাঝরাত থেকে ফুলভাঙ্গা বা কালিনাচ শুরু হয়। তারপর প্রতিমা আসনে অবস্থান নেয়। মেলা হয় চৈত্র মাসের শেষের দু’দিন ও পহেলা বৈশাখী। আগে মেলা হতো পুরো বৈশাখী মাসব্যাপী। এখন হয় মাত্র ৩ দিন। শেষ দিনের গোধুলী লগ্নে চড়ক গাছ আনুষ্ঠিক ভাবে পোঁত হয়। এর আগে চড়ক গাছে পূজা দেয়া হয় ফুল, দুধ ও চিনি দিয়ে। দোলবাড়িতে মহাদেব মূর্তিটি আসনে তোলা হয় ২৮ চৈত্র। ৭ বৈখাখ নামানো হয়। ১৩ জন প্রধান বৃত্তা ৬ দিন উপোস করতে হয়।
বোঁথড় একটি গ্রাম। চাটমোহর পৌর সদরের উত্তরে বড়াল নদীর পাড়ের এই গ্রামটি নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে উৎসব মুখর হয়ে উঠে বোঁথড় গ্রামে। দেশ-বিদিশের বহু মানুষ আসে এই মেলায়। নতুন পুরাতন সব জামাইকে আনতে হয় চলনবিল অঞ্চলের এই মেলার সময়। হিন্দু, কি মুসলমান, কি খ্রীষ্টান প্রতিটি পরিবারে ছিল একই নিয়ম। আত্নীয়-স্বজনে ভরে যেতো পাশ্ববর্তী গ্রামগুলো। আগের দিন এমন কোন জিনিস ছিল না, যা মিলতো না বোঁথড়ের চড়ক মেলায়। প্রায় ১৩ হাত দৈঘ্যের শাল গাছটি চড়ক গাছ নামে পরিচিত। তেল মর্দন করতে করতে গাছটি কৃঞ্চবর্ণ ধারণ করেছে। ৮ দিনব্যাপী দুধ চিনি ও ফুল দেয় পূজারীরা। ছাত্র/ছাত্রীরা পূজা দেয় ভালো ফলাফলের আশায়। যুবতীরা পূজা দেয় ভালো বিয়ে বা বরের প্রত্যাশায়। চড়ক গাছটির গায়ে রয়েছে গরুর ক্ষুরের চিহ্ন ও কোচের চিহ্ন।
পূজা উপলক্ষে হাজার হাজার ভক্ত বাতাসা ছিটায় মঙ্গলার্থে। কেউ মানুষকে জলপান করায়। কেউ করে আতিথেয়তা। মানসা হয় ভক্তদের পক্ষ থেকে। মাথায় চুলের জটা কাটা হয়, উপোস করে কেউ কেউ। আরো কত কি। এখনো বোঁথড় চড়ক মেলার যাবতীয় আনুষ্ঠিকতা ঠিক আছে। শুধু কমেছে মেলার লোকোৎসব মাত্রিক জৌলুস। আগে সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শী বিঁধিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘুরানো হয়। এ দৃশ্য দেখার জন্য সন্ধায় মানুষের ঢল নামে। এ মেলাকে কেন্দ্র করে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে অপূর্ব সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। নাগরদোলা, পুতুল নাচ, যাদু প্রদর্শনী, যাত্রাপালা, গানের আসর বসতো এই মেলায়। এখন সে সব ইতিহাস। পূজা ও মেলা উপলক্ষে এখনও দেশে-বিদেশে থেকে বহু ধর্মপ্রাণ হিন্দু আসেন চাটমোহরে। উৎসব মুখর হয়ে ওঠে মেলার আশপাশের গ্রামগুলো।