মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, পাবনা :
পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিসিআইসি অনুমোদিত ডিলারদের বাফার গুদাম থেকে সার উত্তোলনে অনীহা, শ্রমিক ও পরিবহন সঙ্কটে বাঘাবাড়ী ও নগরবাড়ী নৌবন্দরে প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক সার আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। মাসের পর মাস খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় এই সারের কার্যমতা কমে যাচ্ছে। সারের ঝাঁঝাল গন্ধে এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাঘাবাড়ী বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বিদেশ থেকে জাহাজে করে আমদানির পর বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে ওই সার বাফার গুদামে পৌঁছে দেয়া হয়। এ বছর উত্তরাঞ্চলের জন্য যমুনা এন্টারপ্রাইজ, বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট, বাংলাদেশ ট্রেডার্স, গোলাম মোস্তফা ট্রান্সপোর্ট, রেক্স মোটরস, নবাব অ্যান্ড কোম্পানি ও পটন ট্রেডার্স- এ সাতটি এজেন্সি সার পরিবহনের কাজ করছে। সমুদ্র পথে বড় জাহাজে সার আনার পর লাইটার জাহাজের মাধ্যমে সার বাঘাবাড়ী ও নগরবাড়ী বন্দরে পৌঁছে দেয়া হয়। সেখান থেকে সড়ক পথে সার মজুদের জন্য উত্তরাঞ্চলের ১৪টি বাফার গুদামে পাঠানো হয়।
আরোও জানা গেছে, প্রায় তিন মাস ধরে ৩০ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক সার নদী তীরবর্তী ভেজা ও স্যাঁৎসেতে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি ও কুয়াশায় ভিজে, রোদে পুড়ে সারের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নগরবাড়ী বন্দরে দীর্ঘ দিন এ সমস্যা চলছে। নগরবাড়ী-বগুড়া মহাসড়কের পাশেই যমুনা নদীর পাড়, ট্রাক ও বাসটার্মিনালসহ প্রায় অর্ধকিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার সারের বস্তার বড় বড় স্তূপ পড়ে আছে। কিছু কিছু সারের স্তূপ পলিথিন ও ত্রিপল দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। বাতাসে ভাসছে সারের তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধ। বন্দরের আশপাশের এলাকাতেও এ গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এতে এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
এ দিকে চট্টগ্রাম নৌবন্দর থেকে রাসায়নিক সার বোঝাই ১২টি জাহাজ বাঘাবাড়ী ও নগরবাড়ী নৌবন্দরে এসে নোঙর করেছে। শ্রমিক সঙ্কটে দিনের পর দিন জাহাজগুলো আনলোডের অপেক্ষায় রয়েছে। নিয়মানুযায়ী জাহাজ বন্দরে আসার পর আনলোড করে সার ট্রাকে বাফার গুদামগুলোতে পৌঁছে দেয়ার কথা। কিন্তু বন্দরে শ্রমিক ও পরিবহন সঙ্কট এবং বাফার গুদামগুলোতে জায়গা না থাকায় এ সার মাসের পর মাস বন্দরেই পড়ে থাকছে।
বন্দরের ট্রান্সপোর্ট এজেন্ট ও বিসিআইসির বাফার গুদাম সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের পাবনা-সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী, বগুড়া, শান্তাহার, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, রংপুর, লালমনিহাটের মহেন্দ্রনগর, দিনাজপুর, পার্বতীপুর চরকাট, ঠাকুরগাঁও, বিরামপুর ও গাইবান্ধা- এ ১৪ টি স্থানে বাফার গুদাম রয়েছে। গত বছর সার উত্তোলন কম হওয়ায় বাফার গুদামগুলো খালি হয়নি। ফলে বন্দরে যে সার আসছে, তা বন্দর এলাকাতেই পড়ে থাকছে।
নগরবাড়ী বন্দরে নোঙর করা এমভি জববার কার্গো জাহাজের চালক আলী নূর বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৪ হাজার বস্তা সার নিয়ে এসে ছয় দিন ধরে বাঘাবাড়ী বন্দরে বসে আছি। সার পরিবহন ঠিকাদারেরা বলছেন, শিগগিরই জাহাজ থেকে সার আনলোড করা হবে। অথচ শ্রমিক সঙ্কটে দিনের পর দিন এভাবে বসে থাকতে হচ্ছে। অন্য দিকে উত্তরাঞ্চলের বিসিআইসির ডিলারদের যথাসময়ে সার উত্তোলনে অনীহা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে ডিলারেরা বলছেন, পরিবহন সঙ্কটে তারা সার উত্তোলন করতে পারছেন না।
নগরবাড়ী বন্দরের লোড-আনলোড লেবার সরদার ইছাক আলী শেখ বলেন, নগরবাড়ীতে বাফারগুদাম না থাকায় জাহাজ থেকে সার আনলোড করে নদীর তীরে খোলা আকাশের নিচে স্ট্যাক দিয়ে রাখা হচ্ছে। আমন ধান কাটা শুরু হওয়ায় শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে তিনি জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা আওলাদ হোসেন বলেন, মাসের পর মাস সারগুলো খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। এর তীব্র ঝাঁঝে চলাফেরা দুস্কর হয়ে পড়েছে। জননী ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার দুলাল দাস বলেন, নগরবাড়ী সরকারি গেজেটভুক্ত নৌবন্দর হলেও এখানে সরকারের নিজস্ব কোনো সংরণাগার নেই। উত্তরাঞ্চলের জন্য যে পরিমাণ সার নগরবাড়ী বন্দরে আসে, তাতে এখানে বাফারগুদাম নির্মাণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
পাবনা জেলা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইদ্রিস আলী বিশ্বাস বলেন, ডিলারেরা সাধ্য মতো সার উত্তেলন করছেন। অন্য দিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ডিলারেরা জানান, গত বছর চাহিদার তুলনায় সার আমদানি ছিল বেশি। যে কারণে গুদামে মজুদ সার জমাট বেঁধে গেছে। জমাট বাঁধা সার কৃষকেরা না কেনায় ডিলারেরা বাফার গুদাম থেকে সার উত্তোলন করতে পাড়ছেন না। তাদের কাছে সরবরাহ করা সারে বস্তার গায়ে ২০০১ সাল লেখা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের ১৪ টি বাফার গুদামে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন রাসায়নিক সার মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ চীন থেকে আমদানি করা নিম্নমানের সার। এ সারের গুণগতমান বাংলাদেশের কাফকো ও যমুনা সারের চেয়ে অনেক নিম্নমানের। এ নিম্নমানের সার আমদানির ক্ষেত্রে একশ্রেণীর আমদানিকারক, বাফার গুদাম ইনচাজেরা জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাঘাবাড়ী বাফার গুদাম ইনচার্জ সুদের বাবু জানান, ২০০১ সালের কোনো সার বাফার গুদামে স্টক নেই। সরকারি পর্যায়ে চীন থেকে আমদানি করা ইউরিয়া সারের বস্তার গায়ে (জিবি ৪০২০০১) লেখা দেখে এটা প্রচার করা হচ্ছে ২০০১ সালের বলে। মূলত এ সংখ্যা ওই দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং সিরিয়াল কোড। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
বাফার গুদাম থেকে নেয়া ৫০ কেজির প্রতি রস্তা ইউরিয়া সারে দাম ৯৩৫ টাকা। খোলা বাজারে এ সারের দাম ১০০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ৫০ কেজির ৯৩৫ টাকার প্রতি বস্তা ইউরিয়া সার স্থানভেদে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায় বিক্রি করছেন। জমাট বাঁধা ইউরিয়া সার কৃষক কিনতে চান না, এ অজুহাতে ডিলারেরা সার উত্তোলন না করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির চেষ্টা করছেন বলে তিনি জানান।
কৃষিবিদ ড. ইসমাইল হোসেন বলেন, নগরবাড়ী নৌবন্দরে সংরণাগার না থাকায় রাসায়নিক সার খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। দীর্ঘ দিন এভাবে পড়ে থাকায় এ সারের কার্যক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে।