বিশেষ প্রতিনিধি :
বর্ষাকালীন ফল লটকন বাংলাদেশে দিনে দিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলের দোকানের ঝুড়িতে সাজানো বা দড়িতে ঝোলানো থোকায় থোকায় হলদে সবুজাভ রঙের প্রায় গোলাকার ফলগুলো সবার নজর কাড়ে। এ দেশের আবহাওয়াতে এর গড়পড়তা ফলনও বেশ ভালো।Euphorbiaceae পরিবারের এ ফলটির বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea sapida। ইংরেজিতে বার্মিজ গ্রেপ নামে পরিচিত হলেও আমাদের দেশে এ ফলটি বুবি, বুগি, লটকা, লটকো, নটকো ইত্যাদি নামে পরিচিত। মার্চ মাসের দিকে লটকনগাছে ফুল আসে এবং ফল পরিপক্ব হতে চার-পাঁচ মাস সময় লাগে। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে লটকন বাজারে পাওয়া যায়। ১০-১৫ বছর আগেও লটকনের তেমন চাহিদা ছিল না। দামও ছিল কম। সে জন্য কেউ লটকনের স্বতন্ত্র বাগান করার চিন্তা করতেন না। বর্তমানে টক-মিষ্টি সুস্বাদু এ ফলের চাহিদা ও দাম দুটিই বেড়েছে। এমনকি অন্যান্য ফল চাষের তুলনায় লটকন চাষ অনেক বেশি সহজ এবং ফলনও বেশি হওয়ায় চাষিরা বেশি লাভবান হচ্ছেন। লটকন গাছের কাণ্ডে ফলে। গাছের পুষ্টির সুষমতা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গাছের গোড়া থেকে প্রধান কাণ্ডগুলোয় এত বেশি ফল আসে, একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে পাঁচ থেকে ১৫ মণ পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। তখন গাছের কাণ্ড বা ডাল দেখা যায় না। মানভেদে লটকন মণপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়ে থাকে। পাইকাররা নিজেরাই বাগান থেকে লটকন কিনে থাকেন।
বাংলাদেশের সুপরিচিত অপ্রচলিত দেশীয় টক-মিষ্টি ফল লটকন। এটি আকর্ষণীয় মুখরোচক ফল। সাধারণত লটকন হিসেবেই অধিক পরিচিত। ভিটামিন ‘সি’সমৃদ্ধ টক-মিষ্টি স্বাদের ফল লটকনের এখন ভরা মৌসুম। ঢাকা শহরসহ সারা দেশেই এখন এ ফল পাওয়া যায়। লোভনীয় রং ও আকৃতির থোকা এ লটকন। লটকন ফল গোলাকার এবং পাকলে হলুদবর্ণ ধারণ করে। ফল হিসেবে লটকন যেমন পুষ্টিতে ভরপুর, তেমনি ক্যালসিয়াম, ক্যারোটিন ও খনিজ লবণে সমৃদ্ধ।
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজার দখল করে নিয়েছে নরসিংদীর শিবপুরের লটকন। জেলার ৬২৫ হেক্টর জমিতে লটকন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে শিবপুর উপজেলায়ই চাষ হয়েছে ৪২৫ হেক্টরে। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন লটকন উৎপাদন হয়, যার আনুমানিক দাম ২৪-২৫ কোটি টাকা। জানা গেছে, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রামে লটকন চাষ হয়। লাখপুর, শিমুলিয়া, আলীনগর, পাড়াতলা, দুলালপুর, চরুিবর্দী, ভিটিচিনাদী, বিলচিনাদী, দরগারবন্দ, কাজিরচর, হরণখোলা, মানিকদী, নন্দীগাঁও, বাহেরখোলা, ব্রজেরকান্দী, সাধারচর, মৈশাদী, তাতারকান্দী, শুকুন্দী, কালুয়ারকান্দা, সৈয়দেরখোলা, মিয়ারগাঁও, মাছিমপুর, সৈয়দনগর, পুটিয়া, সুনারুতলা, বেতাগিয়া, কামরাবপুব, সুজাতপুর, জাগড়র, ধুপিরটেক, মধ্যনগর, অষ্টানী মিলিয়ে দুই শতাধিক গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে লটকন চাষ হচ্ছে। উপজেলার এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে আঙিনা থেকে শুরু করে প্রায় সব স্থানেই একটি লটকন গাছ পাওয়া যাবে না। কৃষি বিভাগের তথ্যে জানা গেছে, এ অঞ্চলের লটকন মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ২০-২৫টি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এতে আয় হচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।
বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং নরসিংদী জেলাতে ইদানীং লটকনের বাণিজ্যিক চাষ হলেও দেশের অন্য জায়গায় তেমনভাবে এর আবাদ এখনো শুরু হয়নি। বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়া লটকন চাষের জন্য বেশ উপযোগী। তাই সারা দেশেই (নিচু এলাকা বাদে) এর বাণিজ্যিক চাষ করা সম্ভব। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে একটা পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছ থেকে প্রতি মৌসুমে ১০০ কেজি পর্যন্ত লটকন সংগ্রহ করা সম্ভব। বাজারদরও বেশ ভালো। প্রতি কেজির পাইকারি দর প্রায় ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কাজেই কারো বাগানে ১০টি লটকন গাছ থাকলে প্রতি মৌসুমে সহজেই ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
নরসিংদীর শিবপুরে লটকন চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক চাষি। জয়নগর, বঘাব ও যোশর ইউনিয়নসহ সব কয়টি ইউনিয়নে প্রায় ৪৭৫ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মিলে দুই হাজার ৯৫৫টি লটকন বাগান রয়েছে। এদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপজেলার মানুষজনের মধ্যে লটকন চাষে আগ্রহ বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে বাগান। ফলন হচ্ছে প্রচুর। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন শত শত মণ লটকন সরবরাহ হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। এখানকার লটকন মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
জয়নগর : উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, লটকন চাষে পরিশ্রম ও খরচ দুটোই কম। তাই উপজেলার লটকনচাষিরা লাভবান হচ্ছেন। ফলে উপজেলায় দিন দিন লটকনের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জয়নগর, বাঘাব ও যোশর ইউনিয়নসহ সব কয়টি ইউনিয়নে প্রায় ৪৭৫ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মিলে প্রায় দুই হাজার ৯৫৫টি লটকন বাগান রয়েছে। ১০-১৫ বছর আগেও লটকনের তেমন চাহিদা ছিল না। দামও ছিল কম। সে জন্য কেউ লটকনের বাগান একা করার চিন্তা করতেন না। মানভেদে লটকন মণপ্রতি দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হয়ে থাকে। পাইকাররা নিজেরাই বাগান থেকে লটকন কিনে থাকেন। কিশোরগঞ্জের জয়নগর গ্রামে লটকন চাষে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক চাষি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন শত শত মণ লটকন সরবরাহ করা হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। এখানকার লটকন মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের বৃ-বড়ভাগ, কিসমত বড়ভাগ, স্বল্প বড়ভাগ, গোবিন্দনগর, রামজীবনপুর, কাশিমপুর, ইয়ারপুর, অচিন্ত্যপুর ইউনিয়নের খালিজুরী, মখুরিয়া গৌরীপুর সদর ইউনিয়নের কোনাপাড়া, শালিহর, হাটশিরা, মাওহা ইউনিয়নের বীর আহাম্মদপুর, নাহড়া গাগলা, সহনাটি ইউনিয়নের সোনাকান্দি, ঘাটেরকোনা পাছার, লংকাখলা, খান্দার, সিংরাউন্ধ, আমুদপুর রাইশিমূল, ধোপাজাঙ্গালিয়া, ঝলমলা, করমরিয়া, রামগোপালপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামসহ বিচ্ছিন্নভাবে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামের ৮০ হেক্টর জঙ্গলাকীর্ণ জমিতে ছোট-বড় ২৫০ লটকন ফলের বাগান রয়েছে। জানা গেছে, কয়েক দশক ধরে উল্লিখিত গ্রামগুলোতে লটকন ফল কৃষিনির্ভর বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের আর্থিক চাহিদার জোগান দেওয়াসহ অনেকের সংসারে এনে দিয়েছে সচ্ছলতা, তাদের করেছে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী। বিনা পরিশ্রম ও মূলধনবিহীন এ মৌসুমি আয় দেশের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ব্যয় ও আয়ের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই তুলনা করা সম্ভব নয় বলে লটকন বাগানের মালিকরা জানিয়েছেন।
কৃষির ওপর নির্ভরশীল বৃহৎ জনগোষ্ঠীর এলাকা ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক পরিবারের বিশাল অর্থভাগ্যে খুলেছে মৌসুমি ফল লটকন বিক্রি করে। কোনো ধরনের চাষাবাদ ও পরিচর্যা ছাড়াই প্রকৃতিগতভাবে জন্ম নেওয়া পুষ্টিগুণে ভরপুর দেশীয় লটকন ফল (বুবি) বাগানের মালিকরা কয়েক দশক ধরে প্রতি মৌসুমে শুধু লটকন ফল বিক্রি করে ঘরে তুলছেন লাখ লাখ টাকা। এ বছর উপজেলায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা টন দরে লটকন ফল বিক্রি করে বাগান মালিকদের ঘরে উঠবে প্রায় চার কোটি টাকা।
লটকন ইংল্যান্ড, কাতার, সৌদি আরবসহ নানা দেশে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সহায়তায় প্রতিটি জেলাতেই লটকনের বাণিজ্যিক চাষাবাদ করা যেতে পারে।