অসীম মোদক, মহেশপুর ( ঝিনাইদহ)ঃ
বড়শিতে গাথা জল জ্যান্ত তাজা মানুষ। চড়ক গাছে ঝুলিয়ে প্রায় ২৫ ফুট শুন্যে ঘুরাতে ঘুরাতে সন্যাসী ভিম কুমার হালদার ছুড়ে দিচ্ছেন বাতাসা। শুধু ভিম কুমার নয় একে একে ৫ সন্যাসী পিঠে বড়শী বিধে শূন্যে ঘুরে পালন করলেন শিব পুজারই অংশ চড়ক উৎসব। আর গাঁ শিউরে উঠা এই দৃশ্য দেখলেন প্রায় ২০ হাজার নারী- পুরুষ। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের বকুলতলায় প্রতি বছরের ন্যায় গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত হয় চড়ক উৎসব।
মহেশপুর শহর থেকে ৪/৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের একটি গ্রাম ফতেপুরের বকুলতলা বাজার। এ গ্রামের বকুল তলা বাজারে ভারতীয় পঞ্জিকা মতে অনুষ্টিত হয় চড়ক পুজা । হিন্দু ধর্মাবলীরা উৎসব আয়োজনে এ পুজা করে থাকেন। প্রতি বছর এই পুজার মুল আকর্ষন থাকে ৭/৮ জন সন্ন্যাসীর বড়শিবিদ্ধ হয়ে শুন্যে ঘোরা। এবার দু’জন সন্ন্যাসী অসুস্থ থাকার কারণে ৫জন সন্ন্যাসী বড়শী ফোড়ালেন।
স্থানীয়রা জানায়, প্রায় দুশ’ বছর ধরে চলে আসছে এ চড়ক পুজা। আর এ পুজাকে ঘিরে বকুল তলা বাজারে ২ দিন ধরে চলে বর্ণাঢ্য লোকজ মেলা।
ফতেপুরের এ চড়ক মেলার মুল আকর্ষন বড়শিবিদ্ধ হয়ে শুণ্যে ঘোরানো (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় বান ফোড়ানো) এ দৃশ্য অবলোকনের সাথে সাথে মেলাায় কেনা কাটা করতে গতকাল রোববার সকাল থেকে হাজির হয় প্রায় ২০ হাজার নারী পুরুষ। দুপুরের পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে মেলা প্রাঙ্গনে। বিকেলের মধ্যে লোকে লোকারন্য হয়ে যায় পুরো এলাকা। চারিদিকে সাজ সাজ রব। পুরো এলাকা জুড়ে উৎসবের আমেজ। ঠিক বিকাল ৫ টা বাজার সাথে সাথে ৫ সন্ন্যাসী বৈচিতলা গ্রামের ভিম কুমার হালদার, জলিলপুর গ্রামের আনন্দ শর্মা, ফতেপুর গ্রামের মনা কর্মকার, জয় গোপাল হালদার, রথিন দাস ফতেপুর বাওড়ে স্নান করেন। এরপর ৫ সন্যাসী মাটির কলসে জল ভরে মাথায় নিয়ে আসেন মেলা প্রাঙ্গনে তাদের চড়ক গাছের কাছে। ঠিক ৫ টা চল্লিশ মিনিটে প্রথমে ভীম হালদারের পিঠে দুটি বড়শী বিদ্ধ করা হয়। এ সময় স্মরণ করা হয় মহাদেব শিব ঠাকুরকে। এরপর ভীমকে কয়েকজন পুরুষ ধরাধরী করে ঝুলিয়ে দেন চড়ক গাছে। অপর গাছের অপর প্রান্তে থাকা কপিকলের বাঁশ জোরে জোরে ঘোরাতে থাকেন ২০/২৫জন যুবক। চড়ক গাছে লটকে দেওয়ার সাথে সাথে কিছু মহিলা তাদের এক দেড় বছরের শিশু সন্তানকে তুলে দেন সন্ন্যাসীর হাতে। তাকে নিয়েই শুন্যে ঘুরতে থাকে সন্ন্যাসী এ অবস্থায় ছিটিয়ে দেওয়া হয় বাতাসা।
এভাবেই বড়শীতে বিধে ৪/৫ পাক শুণ্যে ঘুরে নেমে আসেন ভীম হালদার। এ নিয়ে ৬ বার চড়ক গাছে চড়লেন তিনি। ভীম হালদার ( ২৮) জানান,এখানে হিন্দুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু সবাই চড়ক গাছে উঠতে পারে না। এতে সাহস লাগে। ভীমের পর একে একে বান ফোড়ালেন আনন্দ শর্মা, মনা কর্মকার, জয় গোপাল হালদার। স্থানীয়রা জানান, আগে শুধুমাত্র পিঠে বান ঝুলিয়েই চড়ক গাছে ঘোরানো হতো। প্রায় শতাধিক বছর আগে এক সন্ন্যাসীর পিঠের চামড়া ছিড়ে পড়ে আহত হওয়ার কারণে বড়শির উপর গামছা পেচিয়ে দেওয়া হয়।
সন্ন্যাসী মনা কর্মকার জানান, শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টির জন্যই তারা প্রতি বছর চড়ক গাছে চড়ে থাকেন। সন্ন্যাসীরা জানান, শরীরে বড়শী বিধার ফলে বড় ধরণের ক্ষতের সৃষ্টি হলেও সামান্যই রক্ত বের হয়। কিন্তু এর জন্য কোন ঔষধ লাগে না। চড়ক গাছ থেকে নামিয়ে গাছের গোড়ায় থাকা সিঁদুর টিপে দিলেই হয়।
সন্ন্যাসীরা আরও জানান, পূর্ব পুরুষদের কাছে শুনেছেন দু’শ বছর আগে এখানে চড়ক পুজা শুরু হয়। আগে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে এ পুজার আয়োজন করা হতো। সেই স্থানে আশ্রয়ন প্রকল্প গড়ে তোলায় এখন ফতেপুর বকুল তলায় চড়ক পুজা হচ্ছে। এ পুজাকে ঘিরে বসে জমজমাট মেলা। লোকজ ঐতিহ্যের হরেক রকম পসরা সাজিয়ে দোকানীরা বেচাকেনা করেন ২ দিন ধরে। মিষ্টির দোকানী মোসলেম আলী (৫০) ১০/১২ রকমের মিষ্টি সাজিয়ে বিকিনিকি করছেন। তিনি এবার চতুর্থ বারের মত মেলায় আসলেও বেচাকেনা বেশ ভালোই হচ্ছে বলে জানান। কুষ্টিয়ার একতারপুরের সখাসিঁদুর বিক্রেতা বিমল সরকার ও বিকিনিকি করছেন তার পণ্য সম্ভার। পুজা ও মেলা কমিটির সভাপতি সুনিল ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক সুবোল কর্মকার জানান, চড়ক মুলত শিব পুজারই অংশ বিশেষ। নানা আনুষ্ঠানিকতায় তা সম্পন্ন করা হয়।